চোখ ওঠা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দিকে তাকালে সুস্থ ব্যক্তির চোখও কি আক্রান্ত হয়?
[ad_1]
বর্তমানে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে চোখের একটি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালগুলোতে ভীড় করছেন রোগীরা। যাকে আমরা সাধারণ ভাষায় বলি ‘চোখ ওঠা’, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটিকে বলা হয় কনজাংটিভাইটিস বা চোখের আবরণ কনজাংটিভার প্রদাহ। সাধারণত গরমে, বর্ষায় এই রোগের প্রকোপ বাড়ে। আর রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ায় ছড়িয়েও পড়ে দ্রুত।
তবে সমাজে প্রচলিত একটি ধারণা আছে যে, চোখ ওঠা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দিকে তাকালে সুস্থ ব্যক্তির চোখও আক্রান্ত হবে৷ কিন্তু বিষয়টি কি আসলেই তাই? চোখ ওঠা বা কনজাংটিভাইটিস কি? এটি কিভাবে ছড়ায়? এই রোগের লক্ষণ কি? এর প্রতিকার কি?
চোখ ওঠা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দিকে তাকালে সুস্থ ব্যক্তির চোখও আক্রান্ত হয় কি?
এই প্রশ্নের উত্তরে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব অপথ্যালমোলজি তাদের ওয়েবসাইটের সাধারণ জিজ্ঞাসা অংশে বলছে, জীবানু আলোকরশ্মির সাহায্যে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। কনজাংটিভাইটিস সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শের সাহায্যে ছড়ায়।
কনজাংটিভাইটিস বা চোখ ওঠা রোগ কি? এটি কি ছোঁয়াচে?
স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট Health line এর কনজাংটিভাইটিস সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যখন চোখের সাদা অংশ লালচে বা গোলাপী হয়ে যায় এবং চুলকানি শুরু হয়, তখন এটিকে কনজাংটিভাইটিস হিসেবে ধরা হয়। এটি ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে হতে পারে, অথবা অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়ার কারণেও হতে পারে।
এদের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসজনিত কনজাংটিভাইটিস উভয়ই অত্যন্ত সংক্রামক বা ছোয়াঁচে। তবে অ্যালার্জিজনিত কনজাংটিভাইটিস ছোঁয়াচে নয়।
একই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের স্বাস্থ্যবিভাগ কনজাংটিভাইটিস সম্পর্কিত একটি ফ্যাক্টশিট প্রকাশ করেছে।
ফ্যাক্টশিটটিতে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, কনজাংটিভাইটিস বিভিন্ন ধরনের আছে।
- ভাইরাসজনিত কনজাংটিভাইটিস ভাইরাস দ্বারা চোখের সংক্রমণের কারণে হয়। যার মধ্যে অনেক ভাইরাস শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, ঠান্ডা বা গলা ব্যথার সাথে যুক্ত।
- ব্যাকটেরিয়াজনিত কনজাংটিভাইটিস নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া দ্বারা চোখের সংক্রমণের কারণে হয় এবং সহজেই ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- অ্যালার্জিজনিত কনজাংটিভাইটিস কিছু নির্দিষ্ট বস্তুর প্রতি শরীরের প্রতিক্রিয়ার কারণে হয়ে থাকে। যেমন গাছপালা, ঘাস এবং আগাছার পরাগ, ধুলোবালি, কন্টাক্ট লেন্স ও প্রসাধনীর ব্যবহার। তবে এ ধরনের কনজাংটিভাইটিস ছোঁয়াচে নয়।
কনজাংটিভাইটিস বা চোখ ওঠা রোগ কিভাবে ছড়ায়?
কনজাংটিভাইটিস বা চোখ ওঠা রোগ যেহেতু ছোয়াঁচে, তাই এটি যে কারো হতে পারে, যেভাবে অন্যান্য ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ ছড়ায়।
কেউ যদি এ ধরনের ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াযুক্ত কিছু ধরে হাত পরিষ্কার না করেই চোখ স্পর্শ করে তবে সে ব্যক্তি কনজাংটিভাইটিসে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমেও এই সংক্রমণ ছড়াতে পারে, যেমন করমর্দন, আলিঙ্গন বা চুম্বন। কাশি এবং হাঁচিও এ সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
কেউ যদি একই কনট্যাক্ট লেন্স বারবার ব্যবহার করে তাহলে তার জন্যও এ ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারণ ব্যাকটেরিয়া লেন্সে বেঁচে থাকতে এবং বৃদ্ধি পেতে পারে।
পাশাপাশি চোখের পুরানো বা ব্যাকটেরিয়া,ভাইরাস দূষিত প্রসাধনী ব্যবহারের মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে। এছাড়া কনজাংটিভাইটিস যৌন যোগাযোগের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে, যদি কেউ সংক্রমিত বীর্য স্পর্শ করে হাত না ধুয়েই চোখ স্পর্শ করে।
এছাড়া আক্রান্ত চোখের পানি এবং অন্যান্য বর্জ্য থেকেই কনজাংটিভাইটিস ছড়াতে পারে।
কিভাবে বুঝবেন আপনি কনজাংটিভাইটিস আক্রান্ত?
ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত কনজাংটিভাইটিসের সংক্রমিত হওয়া এবং লক্ষণ প্রকাশের মধ্যের সময়কাল ২৪ থেকে ৭২ ঘন্টা।
এ সময়ের মধ্যে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত কনজাংটিভাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়।
কনজাংটিভাইটিসের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলো সম্পর্কে স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট Mayoclinic জানাচ্ছে,
- এক বা উভয় চোখে লালভাব
- এক বা উভয় চোখে চুলকানি
- এক বা উভয় চোখে তীক্ষ্ণ অনুভূতি
- এক বা উভয় চোখে আস্তরণ পড়া, যা সকালে চোখ খুলতে বাধা দিতে পারে
- চোখ থেকে অনবরত পানি পড়া
যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের স্বাস্থ্যবিভাগ কনজাংটিভাইটিস সম্পর্কিত তাদের ফ্যাক্টশিট এ অন্যান্য লক্ষণ সম্পর্কে বলছে,
- চোখে মাঝারি থেকে তীব্র ব্যথা
- ঝাপসা দৃষ্টি বা আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি
- ব্যাকটেরিয়াজনিত কনজাংটিভাইটিস হলে এটি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের 24 ঘন্টা পরেও উন্নতি করে না, বা লক্ষণগুলি অব্যাহত থাকে বা আরও খারাপ হয়।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের স্বাস্থ্যবিভাগ কনজাংটিভাইটিস সম্পর্কিত তাদের ফ্যাক্টশিট এ এই রোগের একই লক্ষণ উল্লেখ করেছে।
কনজাংটিভাইটিস এর প্রতিকার কি?
কেউ যদি তার বা তার শিশু সন্তানের কারো চোখে কনজাংটিভাইটিসের লক্ষণগুলি লক্ষ্য করেন তাহলে তাকে প্রথমেই চিকিৎসকের কাছে যেতে পরামর্শ দিচ্ছে স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট Health Line। কারণ, এটি প্রাথমিক অবস্থাতেই রোগ নির্ণয় করতে এবং এর সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
তবে উপসর্গগুলো যদি হালকা হয় এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কোনো লক্ষণ না থাকে যেমন শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, কানে ব্যথা, গলা ব্যথা বা জ্বর তাহলে চিকিৎসকের সাথে দেখা করার আগে এক বা দুই দিন অপেক্ষা করা যেতে পারে। অপরদিকে শিশুদের ক্ষেত্রে এমন সমস্যা দেখা দিলে অবিলম্বে শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
সর্বোপরি কনজাংটিভাইটিসের চিকিৎসা নির্ভর করে এটি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, অ্যালার্জি বা অন্য কিছু দ্বারা সৃষ্ট কিনা তার উপর।
তবে কনজাংটিভাইটিসে আক্রান্তদের এটির সংক্রমণ রোধে কিছু বিষয় মেনে চলা উচিত। যথা:
- চোখ স্পর্শ বা মোছার পরে হাত ভালো করে ধুয়ে নেওয়া। যদি সাবান ও পানি না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা।
- হাত না ধুয়ে অন্য কাউকে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা।
- চোখ স্পর্শ করার পর ব্যবহৃত জিনিসগুলো ফেলে দেওয়া বা সাবধানে ধুয়ে ফেলা।
- চোখের প্রসাধনী বা চোখে ব্যবহৃত অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী ভাগাভাগি না করা (উদাহরণস্বরূপ, তোয়ালে, বা টিস্যু)। এমন কি কাশি বা হাঁচির সময় মুখ ও নাক ঢেকে রাখা।
- ওষুধের প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা।
- সুইমিং পুল ব্যবহার না করা।
- তোয়ালে, কম্বল এবং বালিশের মতো জিনিসপত্র শেয়ার করা থেকে বিরত থাকা।
- সংক্রামিত এবং অ-সংক্রমিত চোখের জন্য এমনকি একই ব্যক্তির জন্য একই চোখের ড্রপ ডিসপেনসার/বোতল ব্যবহার না করা।
- চোখের ড্রপ বা মলম লাগানোর পর হাত ধুয়ে নেওয়া।
এছাড়া ছোট বাচ্চারা কনজাংটিভাইটিসে আক্রান্ত হলে লক্ষণ না ভালো হওয়া পর্যন্ত তাকে স্কুলে না পাঠিয়ে বাড়িতে রাখা ভাল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃদু লক্ষণগুলো কয়েক দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক কারো কনজাংটিভাইটিস হলে কাজে যাওয়া যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে তাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যেমন চোখ স্পর্শ করার পরে আপনার হাত ভালভাবে ধোয়া। যাতে এটি পরবর্তীতে অন্য কারো মাঝে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
আপনার আশেপাশে কনজাংটিভাইটিস আক্রান্ত রোগী থাকলে কি করবেন?
কারো আশেপাশে যদি সংক্রামক (ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত) কনজাংটিভাইটিস আক্রান্ত কেউ থাকে তবে সেক্ষেত্রে এই পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করে তিনি সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে পারেন:
- ঘন ঘন সাবান ও গরম পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নেওয়া। যদি সাবান এবং গরম পানি না পাওয়া যায় তবে সেক্ষেত্রে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা।
- সংক্রামিত ব্যক্তি বা সে যে জিনিসগুলো ব্যবহার করে তার সংস্পর্শে আসার পর হাত ধুয়ে ফেলা। উদাহরণস্বরূপ, সংক্রামিত ব্যক্তির চোখে চোখের ড্রপ বা মলম লাগানোর পরে বা লাগানোর পরে হাত ধোয়া।
- চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা।
- সংক্রমিত ব্যক্তির দ্বারা ব্যবহৃত জিনিসপত্র শেয়ার না করা। উদাহরণস্বরূপ, বালিশ, তোয়ালে, চোখের ড্রপ, চোখ বা মুখের মেকআপ চশমা ইত্যাদি।
মূলত, যখন চোখের সাদা অংশ লালচে বা গোলাপী হয়ে যায় এবং চুলকানি শুরু হয়, তখন এটিকে কনজাংটিভাইটিস হিসেবে ধরা হয়। যাকে বাংলায় বলে চোখ ওঠা রোগ। এটি বিভিন্ন কারণে যেমন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সংক্রমণ অথবা অ্যালার্জির কারণে হতে পারে। এদের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসজনিত কনজাংটিভাইটিস উভয়ই অত্যন্ত সংক্রামক বা ছোয়াঁচে। অ্যালার্জিজনিত কনজাংটিভাইটিস ছোঁয়াচে নয়। অপরদিকে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোনো জীবানুই আলোকরশ্মির সাহায্যে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না যেহেতু তাই কনজাংটিভাইটিস প্রকৃতপক্ষে ছড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শের সাহায্যে। এই সময়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাবোধের মাধ্যমে যে কেউ এই সংক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন।
বিপরীতে মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটি ধারণা চলে আসছে যে, চোখ ওঠা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দিকে তাকালে সুস্থ ব্যক্তির চোখও আক্রান্ত হয়। কিন্তু এই ধারণাটির কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই, এটি সমাজে বহুল প্রচলিত একটি মিথ মাত্র।
সুতরাং, চোখ ওঠা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দিকে তাকালে সুস্থ ব্যক্তির চোখও আক্রান্ত হবে এমন তথ্যটি সঠিক নয়; এটি একটি প্রচলিত মিথ মাত্র।
তথ্যসূত্র
[ad_2]